আতিক সিদ্দিক (অপটোমেট্রি এন্ড লো -ভিসন)
এমপিএইচ (হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা)
উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যকর্মী, রংপুর
মোঃ আরিফুর রহমান (মামুন) নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় যদি গ্রামীণ জনগণকে বাদ দেওয়া হয়। দেশের প্রায় ৬৫% জনসংখ্যা গ্রামে বসবাস করে, এবং এই বিশাল জনগণের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (UNDP) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং গ্রামীণ জনগণের সুস্বাস্থ্যের জন্য স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যদিও কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা অর্জন করেছে, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে কিছু সংশয় ও সমালোচনা রয়েছে। বিগত সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকের মুলা ঝুলিয়ে ইন্টারনেশনাল পুরস্কার বাগিয়ে নিতে পারলেও সেখান থেকে প্রকৃতি পক্ষে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ইফেক্টটিভলী অতটা উপকৃত হয়নি। খোজ নিলে বুঝতে পারবেন গ্রামের বেশির ভাগ মানুষজনও আমার এই কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করবেন। তবে হ্যাঁ স্বাস্থ্য সেবা খাতে উন্নয়নের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক খুব ভালো একটি পদক্ষেপ কিন্তু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা পূরণে ব্যর্থ।
প্রাথমিক চ্যালেঞ্জসমূহ
১. সেবার মান এবং দক্ষতার ঘাটতি: অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও ওষুধের অভাব রয়েছে। WHO এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী অপরিহার্য। গ্রামবাসীরা অনেক সময় যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে স্থানীয় হাকিম বা কোয়াকদের শরণাপন্ন হন, যা স্বাস্থ্য সেবার মানকে আরও নিচে নামিয়ে আনে।
২. সুবিধাবঞ্চিত জনগণের সেবা প্রাপ্তি: নীতিগতভাবে প্রত্যেক কমিউনিটি ক্লিনিক ৬,০০০-১০,০০০ জনকে সেবা দেওয়ার কথা, তবে অনেক এলাকায় এই ক্লিনিকগুলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো বা দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে কার্যকর সেবা দিতে পারছে না। WHO এর নির্দেশনা অনুযায়ী, সেবার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
৩. সরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়নে ঘাটতি: আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেও, বাস্তবে অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক অকার্যকর বা অপর্যাপ্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে। WHO এর মতে, একটি কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে জনগণের আস্থা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ কমিউনিটি ক্লিনিক একটি ইতিবাচক উদ্যোগ, তবে সংস্কার জরুরী প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য খাতে কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য কিছু সংস্কার জরুরী:
১. সেবা সম্প্রসারণ ও নিয়মিত পর্যালোচনা: সেবা দানকারী সিএসসিপিদের চাকরি স্থায়ীকরণ, প্রতিটি ক্লিনিকে নিয়মিত ওষুধের সরবরাহ এবং কর্মী প্রশিক্ষণ ও তদারকি নিশ্চিত করা জরুরি। WHO প্রস্তাব করে যে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও মান উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হলে সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে
২. দক্ষ লোকবলের নিয়োগ: সিএসসিপিদের পাশাপাশি বিএমডিসি রেজিস্ট্রার্ড মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট তথা ডিএমএফ অর্থাৎ সাব এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের নিয়োগ প্রদান করা প্রয়োজন। WHO এর অভিমত অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে যদি দক্ষ কর্মী নিয়োগ করা হয়।
৩. কমিউনিটি অংশগ্রহণ জোরদার: জনগণকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আরও যুক্ত করতে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো দরকার। WHO এর সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ সেবার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
৪. ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি: সাব এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের পাশাপাশি একজন নিয়মিত এমবিবিএস তথা মেডিকেল অফিসার নিয়োগ করা হলে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। WHO এর গবেষণা অনুযায়ী, চিকিৎসার গুণগত মান উন্নত করতে প্রয়োজন সঠিক ও প্রশিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি গ্রামীণ জনগণকে বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়। যদিও কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল একটি ভালো পদক্ষেপ ছিলো, তবে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও সেবার মান বাড়ানোর জন্য কিছু সংস্কার জরুরি। সরকারের উচিত ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম সরবরাহ করা। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে রোগের জটিলতা কমাতে সাহায্য করবে। WHO এর তথ্যানুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে প্রাথমিক চিকিৎসার সুবিধা গ্রামীণ জনগণের কাছে সহজলভ্য করা হলে জটিল রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং তাদের কাজকে স্থায়ীভাবে সংহত করা গেলে, স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান উন্নতি সম্ভব হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় স্থায়ী কাঠামো তৈরি করার এখনই সময়, যাতে আগামীতে প্রতিটি নাগরিক গুণগত চিকিৎসা সুবিধা পান। গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করতে পারব।