হাবিবুর রহমান হানিফ
বদরগঞ্জে তিন ভাই জনপ্রতিনিধি। এর মধ্যে দুই ভাই হয়েছেন সাবেক। দুই ভাই ঠিকাদার। আরেক ভাই ব্যবসায়ী। সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাসা একই চত্বরে। দিনভর দলীয় নেতা-কর্মী ও অনুসারীদের পদচারণে মুখর থাকত বাসাচত্বর। কিন্তু চিরচেনা সেই চত্বর এখন বদলে গেছে। নেই নেতা-কর্মীদের আনাগোনা। ভেতরে-বাইরে খাঁ খাঁ করছে। এলাকার লোকজনের কাছে তাঁরা চৌধুরী পরিবার হিসেবেই খ্যাত।
এলাকার লোকজনের মতে, সাবেক সংসদ সদস্য, পৌরসভার সাবেক মেয়রসহ ছয় ভাই জনরোষে পড়ার ভয়ে পরিবার নিয়ে বাসা ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁরা এখন কোথায় আছেন, তা কেউ জানেন না। এ ঘটনা রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরই ওই ছয় ভাই পরিবার নিয়ে বাসা ছেড়েছেন। আজ শুক্রবার পর্যন্ত ১৮ দিনেও তাঁরা বাসায় ফেরেননি।
ছয় ভাইয়ের তিন ভাই জনপ্রতিনিধি। তাঁরা হলেন রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম মো. আহসানুল হক ওরফে ডিউক চৌধুরী, তাঁর আপন চাচাতো ভাই বদরগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হক ওরফে টুটুল চৌধুরী ও আহসানুলের সহোদর বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শান্তু চৌধুরী। সংসদ সদস্যের অপর দুই চাচাতো ভাই লিঙ্কন চৌধুরী ও লিটন চৌধুরী ঠিকাদারি কাজ করেন। অবশ্য লিটন চৌধুরী একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতাও করেন। তাঁরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আরেক চাচাতো ভাই উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক পলিন চৌধুরী। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করেন।
বদরগঞ্জ পৌরসভার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একই চত্বরে ওই ছয় ভাইয়ের পৃথক ফ্ল্যাট বাসা। এই বাসাগুলোতে যাতায়াতের প্রধান ফটক রয়েছে একটি।
স্থানীয় অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ছয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকাকালে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দালালি, ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়া, সাধারণ মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন ও মামলা দিয়ে হয়রানি, অত্যাচার নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক ও সাবেক মেয়র আহসানুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ও চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালে বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ সরকারীকরণ ঘোষণার সময় কোটি টাকা উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ওই সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। পরে ওই ঘটনায় ওই কলেজের অধ্যক্ষ মু. মাজেদ আলী খান ওই সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে কলেজটি সরকারীকরণের অভিযোগ তুলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদরগঞ্জ পৌরসভায় বর্তমানে ১৯টি প্রকল্পের অধীনে অপরিকল্পিতভাবে নালাসহ দুটি ছোট সেতু নির্মাণ ও রাস্তা সংস্কারে প্রায় ২৬ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। কাজগুলো নামে-বেনামে করছেন সাবেক মেয়র, তাঁর দুই ভাইসহ দলীয় কয়েকজন নেতা-কর্মী। এসব কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বদরগঞ্জ পৌরবাজারের দুই ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, নালা নির্মাণে নিম্নমানের পাথর, ইট, সিমেন্ট ও রড ব্যবহার করে তা ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। কাজে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। কোনো কোনো নালা অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় তা কোনো কাজে আসবে না।
এলাকার সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৪ সাল থেকে রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে টানা সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন আবুল কালাম মো. আহসানুল হক। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আহসানুল হক ও বিষ্ণুপুরের ইউপি চেয়ারম্যান শান্তু চৌধুরীও একই কায়দায় নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। এসব কারণে ৪ আগস্ট ওই ছয় ভাইয়ের বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিনে তাঁরা সপরিবার পালিয়ে গেলে বিক্ষুব্ধ লোকজন তাঁদের বাসাগুলোতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। এ সময় সাবেক মেয়রের বাসা থেকে অন্তত ছয় হাজার খয়রাতি কম্বল উদ্ধার করে উপস্থিত মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য, পৌর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধি তিন ভাই ক্ষমতায় থাকাকালে ব্যাপক অনিয়ম, লুটপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে ও চাকরি দেওয়ার নামে টাকা গ্রহণ, ভিন্নমতের মানুষকে মামলায় ফেলে হয়রানি, নির্যাতন ও হেয় প্রতিপন্ন করতেন। তাঁদের দাপট দেখিয়ে উপজেলায় ও পৌরসভার বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেন অপর দুই ভাই লিটন চৌধুরী ও লিঙ্কন চৌধুরী। ছয় ভাইয়ের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ কারণে তাঁদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালানো হয়। তাই জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা পরিবার আত্মগোপনে চলে যান।
উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন বলেন, চৌধুরী পরিবার বদরগঞ্জের মানুষকে শাসন করতেন। ভিন্নমতের লোকজনের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ মামলায় ফেলে হয়রানি করতেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ছয় ভাইয়ের এক ভাই পলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার অনিয়ম, দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ ছিল না, করিওনি। মানুষ না বুঝে আমার বাসায় অগ্নিসংযোগ করেছিলেন।’
মুঠোফোন বন্ধ থাকায় ওই অভিযোগগুলোর বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মেয়রসহ অপর পাঁচ ভাইয়ের বক্তব্য জানা যায়নি।