কক্সবাজার প্রতিনিধি/ আবির হোসেন সান
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হওয়ার অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাসহ ১৮৭ জনের নামে আদালতে মামলা করেছেন কফিল উদ্দিন নামের এক যুবলীগকর্মী। সোমবার (১৮ নভেম্বর) আদালতে মামলা করেন তিনি।
এই মামলার পরপরই শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা-সমালোচনা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মামলার বাদীর বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় অস্ত্র ও মাদকসহ তিনটি মামলা এবং আনোয়ারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে একাধিকবার কারাগারেও গেছেন তিনি।
গত সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে মামলা করেন কফিল উদ্দিন। মামলাটিতে তিনি সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ ২৭ জন পুলিশ কর্মকর্তাকেও আসামি করেন। এর পর বাদী কফিলের পরিচয় বেরিয়ে এলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
এজাহারে কফিল ঠিকানা উল্লেখ করেছেন- চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন গ্রামের মৃত জেবল হোসেনের ছেলে। তিনি নগরের নন্দনকানন ২ নম্বর গলিতে থাকেন। নিজেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী বলে উল্লেখ করেছেন।
পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) তথ্য অনুযায়ী, ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র আইনে চারটি মামলা রয়েছে কফিলের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৮ মে গ্রেপ্তার হন তিনি।
‘কপিল উদ্দিন’ ও ‘কিরিচ কপিল’ নামে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আইডি রয়েছে তার। সেসব আইডিতে তিনি নিজেকে যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও আরেক যুবলীগ নেতা রিটু দাশ বাবলুর কর্মী পরিচয় দিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। বাবর ও বাবলু দুজনই সিআরবি জোড়া খুন মামলার আসামি। বাবলু একটি হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এছাড়া কফিল হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন একাধিকবার। ‘কিরিচ গ্রুপ’ নামে কিশোরদের একটি গ্যাংও রয়েছে তার।
গত সোমবার করা মামলায় কফি অভিযোগ করেন, ১ থেকে ৪ নম্বর আসামির নির্দেশনায় ৫ থেকে ১৮৭ নম্বর আসামি আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল, সাউন্ড গ্রেনেড, গোলাবারুদসহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনরতদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আসামিরা আন্দোলনরতদের গুলিবর্ষণ, সাউন্ড গ্রেনেড ও ককটেল নিক্ষেপ করে এলোপাতাড়ি হামলা করে। আসামিদের ছোড়া গুলি ও ককটেলের স্প্লিন্টার তার বাম হাতে লেগে গুরুতর আহত হন। আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হামলার শিকার হন। পরে বেসরকারি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন।মামলার আসামিদের মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসিন ঘটনার দিন ঢাকার তেজগাঁও থানায় কর্মরত ছিলেন। আরেক পরিদর্শক নেজাম উদ্দিন বদলিজনিত কারণে চট্টগ্রামে ছিলেন না। তবে ২০২১ সালে ছিনতাই মামলায় যখন কফিলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ তখন নগরের কোতোয়ালি থানার ওসি ছিলেন নেজাম উদ্দিন। এছাড়া ঘটনাস্থল নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগে হলেও আসামি করা হয়েছে উত্তর বিভাগের পাঁচলাইশ থানার সাবেক ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা, চান্দগাঁও থানার সাবেক ওসি জাহিদুল কবিরকে। খুলশী থানা, চান্দগাঁও থানা ও বাকলিয়া থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে যারা ঘটনার দিন অন্য এলাকায় কর্মরত ছিলেন।
অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনে আহত হিসেবে ‘রেড জুলাই’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ওয়েব সাইটে আহতের তালিকায় কফিলের নাম দেখা যায়। তার অপরাধের কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়ার পর বুধবার সংগঠনটির ওয়েবসাইট থেকে তার নাম মুছে দিয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
তাতে বলা হয়, ‘কফিল উদ্দীনের যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, অন্যান্য অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ ও প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে তার নাম আমাদের ‘রেড জুলাই ডট লাইভ’ ওয়েব সাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই ব্যক্তির কাছ থেকে কেউ কোথায়ও কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হলে তা নিকটস্থ থানায় জানানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।’
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘রেড জুলাই’য়ের চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আবু বকর বলেন, ‘কফিল বারবার নিজের নাম আহত হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিরক্ত করছিল। পরে তার চিকিৎসাপত্র ও ছবি দেখে তাকে আহতের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরে জানতে পারি তিনি পেশাদার অপরাধী। বিষয়টি সংগঠনের ঊর্ধ্বতনদের জানানোর পর তার নামে ওয়েব সাইট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই তালিকা ব্যবহার করে কোনো অপরাধ কার্যক্রম করলে থানায় অভিযোগ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুবলীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন কফিল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগ করা অন্যায় কিছু না। সমন্বয়কদের অনেকে ছাত্রলীগ করেছেন। ওই সময় সরকার দলীয় রাজনীতি করলেও বিবেকের তাড়নায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছিলাম। এটা সত্যি আমি বাবর ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতিতে ছিলাম।’
ছাত্র আন্দোলনে গুলিবর্ষণে অভিযুক্ত হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরকে আসামি না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবর ভাই এবং অন্যান্যদের দেখিনি সেখানে, তাই আসামি করা হয়নি।’
তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে কফিল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি অপরাধও প্রমাণ করতে পারবে না। একটি গ্রুপ আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’